- নারী কল্যাণ ও সংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ের গুরুত্ব বর্ণনা কর।
ভূমিকা-
বাংলা, পাক-ভারত উপমহাদেশে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কার, জাতিভেদ ও বর্ণভেদ প্রথা, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং হিন্দুধর্মের সংস্কারের লক্ষ্যে উনিশ শতকে কতকগুলো সংস্কার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। তাদের মধ্যে একটি অন্যতম সংস্কার ও আন্দোলনধর্মী প্রতিষ্ঠান হলো ব্রাহ্মসমাজ। ভারতবর্ষের পুনর্জাগরণের অগ্রদূত রাজা রামমোহন রায় কিছু আধুনিক পশ্চিমা আদর্শের প্রভাবমুক্ত যুক্তিসম্পন্ন ও উদারনৈতিক বন্ধুর সহযোগিতায় নতুন ধর্মমত ও পথের সন্ধানে ১৮২৮ সালে এ 'ব্রাহ্মসমাজ' প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার আগে তিনি ১৮১৫ সালে আত্মীয় সভা এবং ১৮২১ সালে 'ইউনিটারিয়ান কমিটি' নামে আর একটি সভা স্থাপন করেন। কিন্তু নানাবিধ কারণে এ সভা দুটো খুব বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করতে সক্ষম না হওয়ায় এগুলোকে পুনর্গঠিত করে তিনি ব্রাহ্মসমাজ গড়ে তোলেন।পরম নিরাকার এক ব্রাহ্ম বা সৃষ্টিকর্তার উপাসনার জন্য এর নাম দেওয়া হয় ব্রাহ্মসমাজ।
ব্রাহ্মসমাজের অবদান। নিম্নে ব্রাহ্মসমাজের অবদান তুলে ধরা হলো-
১. উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা-
১৮৩০ সালের ২৩ জানুয়ারি কলকাতায় ব্রাহ্মসমাজের নতুন ভবন নির্মিত হয়। এ উপাসনা মন্দিরে জাতি-ধর্ম-বর্ণ শ্রেণি নির্বিশেষে পরমেশ্বরে উপাসনার জন্য উন্মুক্ত করা মূর্তি, চিত্র বা প্রতীকী ব্যবহার, মদ্যপান, অন্য ধর্ম ওক্সালিহিংসা নিহিত ঘোষিত হয়। সভা-সমিতির মাধ্যমে পরম স্রষ্টার ধ্যান-ধারণার প্রসার, প্রেম-প্রীতি, ভক্তি ভালোবাসা, দয়া-দাক্ষিণ্য নৈতিক চরিত্র প্রভৃতি সৎগুণাবলির বিকাশ সাধনের প্রচেষ্টা চালানো হয়।
২. সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ-
হিন্দু সমাজে প্রচলিত জঘন্য ও নিষ্ঠুর প্রথা সতীদাহ উচ্ছেদে ব্রাহ্মসমাজ কার্যকর ভূমিকা পালন করে। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীকে সতী হিসেবে মানুষের গায়ের লোম সংখ্যা বছর পতিসহ সুখে বসবাসের লোভ দেখিয়ে স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় পড়িয়ে মারা হতো। রাজা রামমোহন রায় এ অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে সচেতনতা ও জনমত সৃষ্টি করে। ১৮১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর লর্ড বেন্টিঙ্ক সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ আইন প্রণয়ন করে এর বিরুদ্ধে দণ্ডাদেশ জারি করেন। প্রাচীন পন্থি গোঁড়া হিন্দুরা এর প্রতিবাদ করেন। তার সরকার এবং প্রিভি কাউন্সিলের কাছে এই আইন প্রত্যাহারের জন্য আপিল করে। রাজা রামমোহন বিভিন্ন যুক্তিতর্কসহকারে সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদেরাজা রামমোহন বিভিন্ন যুক্তিতর্কসহকারে সতীদাহ প্রথা কমন্স সভায় গমন করেন। ফলে গোঁড়া হিন্দুদের আপিল বরখাস্ত হয় এবং চিরদিনের জন্য সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ হয়।
৩. শিক্ষাবিস্তার-
শিক্ষা বিশেষত নীতিমূলক ও নারী শিক্ষা বিস্তারে ব্রাহ্মসমাজ ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। কেশবচন্দ্রের পরিচালনায় কোলকাতা কলেজ, নারী শিক্ষার জন্য ভিক্টোরিয়া কলেজ (১৮৭০) কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের পরীক্ষা ব্যবস্থা (১৮৮৭) ও অনন্যা স্কুল কলেজ, নৈশ্যবিদ্যালয়, শ্রমিকদের জন্য পৃথক বিদ্যালয় প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়। বই-পুস্তক ও পত্রিকা প্রকাশ, গ্রন্থাগার প্রভৃতির মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারে এ আন্দোলন অবদান রাখে। নারী শিক্ষার জন্য অন্তঃপুর স্ত্রী শিক্ষার সভা গঠিত হয়।
৪. কুসংস্কার দূরীকরণ-
হিন্দু সমাজে প্রচলিত বহুবিধ কুসংস্কার প্রতিরোধ ও প্রতিকারে ব্রাহ্মসমাজ সফল হয়। যেমন বিধবাদের পুনঃবিবাহ, বাল্য ও বহু বিবাহ রোধ, নারীপুরুষের বিয়ের বয়স বৃদ্ধি, অসমবর্ণ বিয়ে সঙ্গতকরণ যৌতুক প্রথা বর্জন, অজ্ঞতা দূরীকরণ হিন্দু রমণীদের সম্পত্তিতে মালিকানা প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি। ব্রাহ্ম মহিলাদের প্রচেষ্টায় নারী শিক্ষা সম্প্রসারণ ও কুসংস্কার দূরীকরণ কার্যক্রম বেশ ফলপ্রসূ হয়েছিল। তারা বাল্য বিয়ে রোধকল্পে বাল্য বিয়ে নির্ধারণী সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। গোঁড়ামি বর্ণভেদ প্রথা প্রভৃতি দূরীকরণেও ব্রাহ্মসমাজ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টিতে এর অবদান অনন্য।
৫. কার্যক্রম পরিচালনা-
সমাজসেবা ও ত্রাণকাজেও ব্রাহ্মসমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। উত্তর ও পশ্চিম ভারতে দুর্ভিক্ষ চলাকালে এবং ভাগীরথীর তীরে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ দেখা দিলে সমাজের পক্ষ থেকে কমিটি গঠন করে দুর্গতদের সেবা করা হয়। তাছাড়া সমাজ জলা জঙ্গল উচ্ছেদ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি প্রকল্প গ্রহণ করে।
৬. মাদকদ্রব্য বর্জন-
১৮৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত ভারত সংস্কার সভা বিভাগের মাধ্যমে মদ ও মদ্যপান নিবারণে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। সরকারের কাছে মাদকদ্রব্য আবেদনের ফলে মদ্য ব্যবসায়ে বিধি নিষেধ আরোপিত হয়। ১৮৭৮ সালে গঠিত আশালতা দল নামক প্রতিষ্ঠা মাদকদ্রব্য গ্রহণের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করে।
৭. আন্দোলনের সম্প্রসারণ-
ব্রাহ্মসমাজ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, একেশ্বরবাদ প্রচার, কুসংস্কার দূরীকরণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক পদক্ষেপের মাধ্যমে সম্প্রসারিত হয়। তবে গোঁড়াপন্থি যুক্তিবাদী ও উদারপন্থিরা ব্রাহ্মসমাজের সম্প্রসারণে এগিয়ে আসেন। দেবেন্দ্রনাথ, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, নীলরতন হালদার, কেশবচন্দ্র প্রমুখ মনীষীর প্রচেষ্টার ব্রাহ্মসমাজ সমাজসংস্কারে ব্যাপক আন্দোলন ও আলোড়ন সৃষ্টি করে। বাংলাদেশেও এর সম্প্রসারণ ঘটে এবং ১৮৪৬ সালে ঢাকায় সর্ববৃহৎ ও স্থাপত্য কারুকার্য সমৃদ্ধ ব্রাহ্ম মন্দির স্থাপিত হয়।
উপসংহার-
পরিশেষে বলা যায় যে, ব্রাহ্মসমাজ ভারতবর্ষের বিভিন্ন কুসংস্কারের মূলোৎপাটন, শিক্ষাবিস্তার, সম্প্রীতি স্থাপন, নারীদের সমান মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সর্বোপরি আধ্যাত্মিক উন্নতিতে অনন্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়। সতীদাহ প্রথার বিলোপ পর্দা প্রথার বিলোপ শিশুবিবাহ নিরুৎসাহিতকরণ বহুবিবাহ রোধ প্রভৃতি ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্রাহ্মসমাজ সদ্য সচেষ্ট ছিল। ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত রামমোহন রায় কর্তৃক প্রতিটিতে ব্রাহ্মসমাজ সমগ্র ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
96 টি প্রশ্ন
95 টি উত্তর
0 টি মন্তব্য
2 জন সদস্য