- অথবা, ফরায়েজি আন্দোলনের ভূমিকা বা তাৎপর্য বর্ণনা কর।
ভূমিকা-
১৭৫৭ সাল পর্যন্ত মুসলমানগণই ভারতবর্ষ শাসন করে আসছিল। এদিক দিয়ে মুসলমানগণ ছিল এক ঐতিহ্যের দাবিদার। কিন্তু ১৭৫৭ সালে পলাশির প্রান্তরে পরাজয়ের ফলে ইংরেজরা এদেশ দখল করে নেয়। তাই ইংরেজরা মুসলমান সংস্কৃতি বিরোধী আগ্রাসন চালায়। আর এ আগ্রাসন ও বিপর্যয়ের হাত হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য হাজী শরীয়ত উল্লাহ দৃঢ়সংকল্প নিয়ে ফরায়েজি আন্দোলন গড়ে তোলেন। মূলত ধর্মীয় উদ্দেশ্যে এ আন্দোলন পরিচালিত হলেও পরে তা রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। আর তার এ আন্দোলনের ফলেই বাংলার মুসলমান শোষণ হতে মুক্তি পায়।
সমকালীন মুসলিম সমাজের ওপর ফরায়েজি আন্দোলনের প্রভাব-
নিম্নে সমকালীন মুসলিম সমাজের ওপর ফরায়েজি আন্দোলনের প্রভাব আলোচনা করা হলো-
১. হতাশাগ্রস্ত মুসলমানদের বিশ্বাস ও চেতনার জাগরণ-
ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে ফরায়েজি আন্দোলন মুসলমানদের জন্য এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে যা তাদেরকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছে। এ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য হতাশাগ্রস্ত মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় অনভূতি ও বিশ্বাস জাগ্রত করে তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। ফরায়েজি আন্দোলনের প্রভাব সম্পর্কে মন্তব্য করতে ইংরেজ লেখক ওয়াইজ বলেন, "ফরায়েজি আন্দোলন বাংলার উদাসীন মুসলমানদের উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করে তাদের অন্তর্নিহিত বিশ্বাস এবং চেতনাকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়।" তৎকালীন ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশে নীলকর, জমিদার, আমলা ও শাসকগণের অত্যাচার থেকে মুসলমানদেরকে রক্ষা করা, শ্রেণি বৈষম্য বিলোপ, কবর ও পির পূজা বন্ধকরণ এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের মুসলমানদেরকে আত্মসচেতন এবং উদ্বুদ্ধকরণের ক্ষেত্রে ফরায়েজি আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম।
২. আদর্শ সমাজ গঠন-
মানুষ সামাজিক জীব।সমাজে মানুষ তার অধিকার সুযোগ ও স্বাধীনতা' ভোগ করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ব্রিটিশ শাসন আমলে বাঙালি মুসলমানগণ সে অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত হয়। এ প্রেক্ষাপটে হাজী শরীয়ত উল্লাহ মুসলমানদের আর্থসামাজিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ফরায়েজি আন্দোলনের ডাক দেন এবং তার এ আন্দোলন মুসলমানদের হৃত সামাজিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিস্তার করতে থাকে। তখন এর বিরুদ্ধে হাজী শরীয়ত উল্লাহ কঠিন অবস্থান নেন এবং মুসলমানদের এ আন্দোলনের পক্ষে আনয়ন করে সুষ্ঠু ন্যায়সঙ্গত সামাজিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন।
৩. ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সূচনা-
হাজী শরীয়ত উল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র মোহাম্মদ মহসীন ওরফে দুদু মিয়া এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ধর্মীয় অনভূতিকে জাগ্রত করা এবং মুসলমানদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এ আন্দোলন রাজনৈতিক রূপ লাভ করে। দুদু মিয়ার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আন্দোলনটি শক্তিশালী ও জনপ্রিয় হয়ে উঠে। তিনি পূর্ববঙ্গকে কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত করে প্রত্যেক অঞ্চলের জন্য একজন খলিফা বা প্রতিনিধি নিয়োগ করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ফরিদপুর, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও পাবনা জেলা ছাড়াও দূরবর্তী আসাম প্রদেশ বিশেষ করে সিলেট জেলা ও পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত আন্দোলনের প্রসার ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি বিভিন্ন অত্যাচার হতে মুসলমান কৃষক-প্রজাদের রক্ষা করাই ছিল আন্দোলনের প্রভাব।
৪. কর ব্যবস্থার বিলোপ সাধনের চেষ্টা-
দুদু মিয়া জমিদার কর্তৃক প্রজাদের উপর কর ধার্যের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহই ভূমির মালিক। কোনো মানুষেরই ইহা উত্তরাধিকার সূত্রে দখল করে এর উপর কর ধার্য করার অধিকার নেই। এর ফলে জমিদারগণ তার ঘোর বিরোধী হয়ে উঠে এবং এর বিরুদ্ধে কতকগুলো মিথ্যা মামলা তারা দায়ের করে। তা সত্ত্বেও তিনি আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারেন। ফলশ্রুতিতে ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে দুদু মিয়াকে আলীপুর কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। এর ফলে আন্দোলন অনেকটা দুর্বল হয়ে যায়।
৫. সাম্প্রদায়িক বিরোধ সৃষ্টি-
ফরায়েজি আন্দোলন ধর্ম সংস্কারমূলক হলেও এটি অন্য ধর্মের বিরোধিতা করেনি। এ আন্দোলন পরবর্তীতে অনেকটা সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঠেলে দেয়। কারণ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রায়তদের অধিকাংশ ছিল মুসলমান এবং জমিদারগণ ছিল হিন্দু। ফলে হিন্দু জমিদার ও মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিরোধের রূপ নেয়। হিন্দু জমিদারগণকে ব্রিটিশ সরকার সমর্থন করলেও শ্রেণি দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। এর ফলশ্রুতিতে শ্রেণি স্বার্থের দ্বন্দ্ব এক সময় সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের চরিত্র লাভ করে।
৬. কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষকে প্রতিবাদী করে তোলে-
হাজী শরীয়ত উল্লাহর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, অসীম সাহস এবং কৃষক, শ্রমিক, মজুরদের সমবেত প্রচেষ্টায় স্বল্প সময়ের মধ্যে ফরায়েজি আন্দোলন সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে সমগ্র বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। এ আন্দোলনের ফলে বাংলার কৃষক, শ্রমিক, তাঁতী ও কারিগরদের জীবনে জাগরণের নতুন স্পব্দন সৃষ্টি হয়। মুসলমানরা জমিদার, আমলা ও নীলকরদের অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শেখে, যা তাদেরকে অধঃপতন থেকে উদ্ধার পেতে আত্মপ্রত্যয়ী হতে সাহায্য করে। শোষিত জনগণকে অধিকার সচেতন করে তোলাই ফরায়েজি আন্দোলনের পরম কৃতিত্ব। জেমস টেলরের বর্ণনা অনুযায়ী, ১৮৪০ সাল নাগাদ ঢাকা শহরের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক হাজী শরীয়ত উল্লাহর মতবাদ স্বেচ্ছায় গ্রহণ করে।
৭. সচেতনতা সৃষ্টি ও আত্মপ্রত্যয়ী করে তোলা-
ফরায়েজি আন্দোলনের মাধ্যমেই মুসলমানদেরকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলা হয়। তাই সার্বিক দিক থেকে বলা যায় যে, তৎকালীন সময়ে ফরায়েজি আন্দোলনের ব্যাপক ও বহুমুখী গুরুত্ব ছিল। ঐতিহাসিক ওয়াইজ-এর মতে, "ফরায়েজি আন্দোলন বাংলার মানুষদের উৎসাহিত ও আত্মপ্রত্যয়ী করার মাধ্যমে তাদের অন্তর্নিহিত বিশ্বাস ও চেতনাকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়।"
উপসংহার-
পরিশেষে বলা যায় যে, হাজী শরীয়ত উল্লাহর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, অসীম সাহস এবং কৃষক শ্রমিক মজুরদের প্রচেষ্টায় ফরায়েজি আন্দোলন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে সমগ্র বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। জমিদার, নীলকর, মহাজন ও আমলাদের অমানুষিক নির্যাতন ও অত্যাচার এবং ধর্মীয় কুসংস্কার ও গোঁড়ামি থেকে মুসলমানদের রক্ষার জন্য এ আন্দোলনের কার্যক্রম পরিচালিত হয় এবং সমকালীন মুসলিম সমাজ সংস্কারে এর প্রভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ ছিল।
96 টি প্রশ্ন
95 টি উত্তর
0 টি মন্তব্য
2 জন সদস্য