- কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিবরণ দাও।
- অথবা, ১৭৯৩ সালে প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা কর।
ভূমিকা-
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় দেওয়ানি অধিকার লাভ করে ১৭৬৫ সালে। কতিপয় কর্মচারীর দুর্নীতির জন্য বাংলার ভাগ্যাকাশে নেমে আসে অন্ধকার। কারণ দেওয়ানি ক্ষমতা লাভের পর কোম্পানির কর্মচারীদের অত্যাচার, শোষণ, নির্যাতন বেড়েই চলে। তাই সংঘটিত হয় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। এসব কারণে ব্রিটিশ সরকার কোম্পানিকে দায়ী করে এবং ভারতবর্ষে নতুন একজন গভর্নর জেনারেল হিসেবে ওয়ারেন হেস্টিংসকে পাঠায়। হেস্টিংসের আমলে প্রথম রেগুলেটিং এ্যাক্ট পাস হয় যা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল। এরপর ভারতে গভর্নর জেনারেল হয়ে আসেন লর্ড কর্নওয়ালিস। এ কর্নওয়ালিসের শাসনামলেই পূর্বের অনেক আলোচনা-সমালোচনার পর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ঘোষণা করা হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পটভূমি-
১৯৯৩ সালে চিরস্থায়ী নিম্নে আলোচনা করা হলে বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হলেও এর সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত ছিল।
১. দাও-এর মতবাদ-
কোম্পানি যখন ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভ করে তারপর বাংলার চরম অবস্থা উপলব্ধি করে সমস্যা সমাধানের জন্য শাসন সম্পর্কে দুজন পরামর্শদাতার নাম ইতিহাসে খ্যাত। এরা দুজন হলেন আলেকজান্ডার দাও ও হেনরি পেটুলো। আলেকজান্ডার দাও কোম্পানি শাসনকার্য পরিচালনার প্রতি উপহাস করে বলেন যে, নবাবি শাসননীতি ছিল "মধুর চাকের মধু খাওয়া, চাক ধ্বংস করা নয়, কিন্তু ইংরেজরা এর মধু খেয়ে মধুর চাক পর্যন্ত ধ্বংস করে দেয়।" তাই কোম্পানির অত্যাচারী শাসন থেকে বাংলার অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার পিজন্য তিনি ভূমি সংস্কারের পরামর্শ দেন। এতে তিনি বলেন-
২. বার্ষিক জমিদারি বন্দোবস্তের কুফল-
ওয়ারেন হেস্টিংসের "আজীবন বন্দোবস্ত" ও ফিলিপ ফ্রান্সিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দুটো বোর্ড অব ডাইরেক্টরে বিবেচনার জন্য প্রেরণ করা হয়। কোর্ট উভয় পরিকল্পনাই আপাতত বর্জন করে এবং আদেশ দেয় যে, পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত সরকারের উচিত বার্ষিক মেয়াদে জমিদারদের সাথে ভূমি বন্দোবস্ত করা। ইজারা প্রথা পরিত্যাগ করে শুধু জমিদারদের সাথে ভূমি বন্দোবস্ত করার জন্য কোর্টের সিদ্ধান্ত ছিল ভূমিতে জমিদারিত্বের স্বীকৃতি। যদিও কোর্ট ফ্রান্সিসের পরিকল্পনাকে একটি অতি প্রশংসনীয় ব্যবস্থা বলে গ্রহণ করে তথাপিও তা কার্যকরী করা সম্ভব হয়নি। কারণ এর পশ্চাতে জানা দরকার- ১. স্থায়ী রাজস্ব ব্যবস্থা কি হওয়া উচিত। ২. গভর্নর জেনারেলের পরিকল্পনাকে পাস কাটিয়ে একজন কাউন্সিলরের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের রাজনৈতিক অসুবিধা। তাই এটা কার্যকরী করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে না হলেও অনেকটা অবদান ছিল।
৩. চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য ডাইরেক্টর সভার নির্দেশ-
পীটস ইন্ডিয়া এ্যাক্ট পাস হওয়ার পর বাংলার রাজস্ব সম্পর্কে কোম্পানি নীতি পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। এক্ষেত্রে দেখা যায়, বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত ইন্ডিয়া অফিসে বাংলার ভূমি ব্যবস্থা কি হওয়া উচিত এ নিয়ে এককভাবে চিন্তা করার কোনো সুযোগ নেই। হয়তো যোগ্যতাও নেই। এ ব্যাপারে যারা গভীর চিন্তা করেছিলেন তারা হলেন ফিলিপ ফ্রান্সিস, জন শো'র ও চার্লস স্টুয়ার্ট। এরা সবাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবক্তা ছিলেন। এমতাবস্থায় কোর্ট অব ডাইরেক্টরস তাদের সমস্ত পরিকল্পনা, স্মারকপত্র, চিঠিপত্রসমূহ সংগ্রহ করে পরীক্ষার পর এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, বাংলার জন্য একমাত্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্তই কাম্য। ১৭৮৬ সালের ১১ এপ্রিল লেখা পত্রে কলকাতা কর্তৃপক্ষকে এ যুগান্ত কারী সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
৪. জন শো'র ও কর্নওয়ালিস বিতর্ক-
১৭৮৬ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কোর্ট অব ডাইরেক্টরস লর্ড কর্নওয়ালিসকে গভর্নর জেনারেল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কোর্ট চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে কার্যকরী করার জন্য কর্নওয়ালিসকে উপযুক্ত বলে মনে করেন। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় কর্নওয়ালিসের/ প্রধান রাজস্ব উপদেষ্টা ও বোর্ড অব রেভিনিউর প্রেসিডেন্ট জন শোর। শোর যুক্তি দেখান যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কার্যকরী করার পূর্বে জানা দরকার।
এরপর কর্নওয়ালিস আশা ব্যক্ত করেন যে, এখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করা হবে। তবে একটু দেরি হয়।
৫. দশসালা বন্দোবস্ত কোর্ট অব ডাইরেক্টরস-
এর নির্দেশনামায় (১২ এপ্রিল, ১৭৮৫) বলা হয়েছিল যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উদ্দেশ্যে একটি ক্ষণস্থায়ী বন্দোবস্ত করা হয়। কোর্টের অনুমোদন লাভের পর সেই স্বল্পমেয়াদি বন্দোবস্তই চিরস্থায়ী বলে ঘোষণা করা হবে। সে নির্দেশ মোতাবেক গভর্নর জেনারেল ইন কাউন্সিল ১৭৮৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বিহার প্রদেশের জন্য দশসালা বন্দোবস্তের প্রস্তাব করেন। এতে শোর ও কর্নওয়ালিসের মধ্যে বিতর্ক দেখা দেয়। এতে প্রস্তাব ছিল যে, "জমিদারদের সাথে বন্দোবস্ত করা হোক এবং নোটিশ জারি করা হোক যে, কোর্ট অব ডাইরেক্টরস কর্তৃক অনুমোদিত হলে তা চিরস্থায়ী বলে গণ্য হবে এবং দশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর বন্দোবস্তে কোনো রদবদল হবে না।" এক পর্যায়ে বিতর্ক দেখা দেয় ঘোষণা নিয়ে। শেষে ১৭৮৯ সালে বিহার প্রদেশে দশসালা বন্দোবস্ত প্রবর্তন করা হয়। প্রস্তাবে বলা হয় যে, বাংলা সন ১১৯৭ সালের ১ বৈশাখ থেকে দশ বছরের জন্য জমিদারের সাথে ভূমি বন্দোবস্ত করা হোক। বন্দোবস্তের নাম দেয়া হয় দশসালা।
৬. কৃষি বিপ্লব ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-
কর্নওয়ালিস কৃষিক্ষেত্রে কিছুটা উন্নতি সাধন করে। জন শো'র ও কর্নওয়ালিসের বিতর্কের সমস্ত কাগজপত্র জমা দেন। সাথে সাথে দশসালা বন্দোবস্তের দলিলপত্রও জমা দেন। তারপর অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ১৭৯২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কোর্ট চূড়ান্ত নির্দেশ কর্নওয়ালিসকে জানায়। ১৭৯৩ সালে ২২ মার্চ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ঘোষণা করেন লর্ড কর্নওয়ালিস।
উপসংহার-
পরিশেষে বলা যায় যে, লর্ড কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল ব্রিটিশ ভারতের কোম্পানি শাসনের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর ফলে সুদীর্ঘকাল ধরে ভারতে কোম্পানির রাজস্ব সম্পর্কে জামিদার ও সরকার জমিদার ও রায়ত ইত্যাদি সম্পর্কে যে জটিলতা ছিল তার অবসান হয়। এছাড়া এ বন্দোবস্তের মাধ্যমে প্রশাসনিক কাঠামোর পুনর্বিন্যাস করা হয়। এছাড়া এ বন্দোবস্তের প্রেক্ষাপট তথা পটভূমি ছিল একটি শোষণ ক্ষমতা দখল করার প্রয়াস যা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল।
96 টি প্রশ্ন
95 টি উত্তর
0 টি মন্তব্য
2 জন সদস্য